বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের একদল সহপাঠীর সাথে শুক্রবার দুপুরে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় বেড়াতে গিয়ে রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হয়েছেন ঢাকার একজন ব্যবসায়ী।
নৌকাভর্তি বন্ধু-পরিজনের সাথে হাওরে বেড়াতে গেলেও কেউ জানেন না তিনি কোথায় গেলেন, কীভাবে নিখোঁজ হলেন। তার সন্ধানে এখন হাওরাঞ্চলে চলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক অভিযান।
এরপর থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত তার খোঁজ মেলেনি।
ঢাকা থেকে বেড়াতে যাওয়া এ দলটিতে সৈয়দ জাহেরুর রহমান সাগর নামে এই ব্যবসায়ীর বন্ধুরা, কয়েকজন বন্ধুর পরিবারের সদস্য শিশু ও নারী সহ মোট ৫০ জন ছিল।
সারাদিন নৌকায় চড়ে হাওরে ঘুরে এবং বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখার পর রাতে যখন ঘাটে পৌঁছে ঢাকা ফেরার জন্য অপেক্ষমান ট্যুরিস্ট বাসে উঠতে যাবেন সবাই তখনই আবিষ্কার হয় মি. রহমান তাদের সাথে নেই।
বন্ধুরা তাকে খুঁজতে ট্রলারে ফিরে গিয়ে তার ব্যাগ এবং মোবাইল ফোন পান, কিন্তু তাকে আর পান না।
জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ভ্রমণ গন্তব্য হাওরাঞ্চলে ছুটির দিনগুলোতে হাজার হাজার মানুষের ভিড় হলেও এমন ঘটনাকে নজিরবিহীন বলছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আসসাদিকজামান বিবিসিকে বলেন, হাওর সংশ্লিষ্ট তিন উপজেলা – ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামে এখন সমন্বিত অনুসন্ধান চলছে।
“আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। নৌ পুলিশ পুরো এলাকায় তল্লাশি চালাচ্ছে। উনাদের ট্রলারটি অষ্টগ্রাম থেকে নিকলী আসার পথে উনি মিসিং হয়েছেন। এ পথে মেঘনা নদীও পড়ে। সবাই মিলে চেষ্টা চালানো হচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
দুপুরে মিস্টার রহমানের সাথে বেড়াতে যাওয়া তার বন্ধুদের একজন শেখ রাজু আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা নৌ পুলিশ ও সাগরের কয়েকজন আত্মীয়কে সাথে নিয়ে হাওরে আছি। পুলিশ ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে”।
কখন হারালেন?
হাওরে বেড়াতে যাওয়ার দলটিতে ছিলেন এমন কয়েকজন বিবিসিকে জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠি, তাদের পরিবার ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে জনা পঞ্চশেক মানুষ শুক্রবার সকালে দুটি বাসে চড়ে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
নিখোঁজ মিস্টার রহমান যে বাসটিতে ছিলেন, সেই বাসটিতে সহযাত্রীদের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
দুপুর একটা নাগাদ তারা নিকলীতে পৌঁছান এবং সেখানে তাদের এক বন্ধুর বাড়ীতে কিছুক্ষণ অবস্থান করে বেলা দুটার দিকে নিকলী থেকে ট্রলারে ওঠেন।
দলটির একজন বায়েজিদ সিকদার বিবিসিকে বলেন, “ট্রলারে একনাগাড়ে আড়াই ঘণ্টার মতো চলার পর আমরা প্রেসিডেন্ট রিসোর্টে পৌঁছাই। সেখানে অল্প সময় অবস্থান করে আমরা আবার ট্রলারে করে অলওয়েদার সড়কের দিকে যাত্রা করি। ছয়টার দিকে দশ মিনিটের মতো সময় সেখানে কাটিয়ে আবার নিকলীর দিকে যাত্রা করি। পুরো পথে আমরা কেউ কোথাও পানিতে নামিনি”।
দলটির সদস্যদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে বহুল আলোচিত অলেওয়েদার সড়কে তিন উপজেলার সংযোগকারী জায়গায় ছবি তোলা এবং পরে আবার ট্রলারে এসে আধঘণ্টা পর ট্রলার চলমান অবস্থায় মাগরিবের নামাজেও অংশ নিয়েছিলেন পরে নিখোঁজ হওয়া সৈয়দ জাহেরুর রহমান।
মাগরিবের নামাজের পর হাওড়ে গভীর অন্ধকারে ট্রলারের এক অংশ থেকে অন্য অংশ ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না এবং মোবাইল ফোনের আলো জ্বাললে পোকামাকড় আসছিল দেখে অনেকে চুপচাপ হয়ে নিজের মতো সময় কাটাচ্ছিলেন।
এশার নামাজের সময় অন্ধকারের কারণে কে কার পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছে সেটি আর কেউ তেমন একটা খেয়াল করেনি বলে জানান মিস্টার সিকদার।
ট্রলারটি সবাইকে নিয়ে নিকলী ঘাটে আসে রাত আটটায় এবং ট্রলার থেকে সবাই যখন নামছিলেন তখন একজন একটি ব্যাগ আর জুতা পড়ে থাকতে দেখে সেগুলো নিয়েই ঘাটে অপেক্ষমাণ বাসে আসে।
বাস ছাড়ার মূহুর্তে মিস্টার রহমান ঢাকা থেকে আসার সময় যার পাশে বসেছিলেন তিনি দেখেন যে আসনটি খালি এবং তিনি অন্যদের জানান যে মিস্টার রহমান এখনো বাসে ওঠেননি।
“এরপর কয়েকজন বন্ধু ট্রলার, ঘাট, দোকানপাটে খুঁজে সাগরকে না পাওয়ায় অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়। আর একটি বাস প্রায় ৩০ জনকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়,” বলছিলেন মিস্টার সিকদার।
স্থানীয়দের নিয়ে একটি ট্রলারে করে তারা হারানো বন্ধুকে খুঁজতে শুরু করেন বিস্তীর্ণ হাওরে।
মধ্যরাতে ঝড় বৃষ্টি কারণে তল্লাশি কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলেও সকাল নাগাদ আবার শুরু হয়।
নিকলি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আসসাদিকজামান বলছেন সমন্বিত তল্লাশি চালানো হচ্ছে ।
“সাধারণত পানিতে কেউ পড়লে ৭/৮ ঘণ্টার মধ্যে মৃতদেহ ভেসে ওঠে। এক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি সময় পেরিয়ে গেছে কিন্তু তেমনি কিছুও আমরা পাইনি”, বিবিসিকে বলেন তিনি।
জনপ্রিয় হয়ে ভ্রমণ গন্তব্য হাওরে নিরাপত্তা কতটা
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে জনপ্রিয় পর্যটন স্পট হিসেবে পরিচিত হয়েছে নিকলী হাওর যার মূল কারণ হলো হাওরের ওপর নবনির্মিত অলওয়েদার সড়ক।
হাওরের তিনটি উপজেলাকে সংযোগকারী সড়কটি দেখতে সেখানে ভিড় করেন শত শত পর্যটক।
তবে সম্প্রতি পর্যটক ব্যাপক বাড়লেও সেখানে বেড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন কোন নিরাপত্তা অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি।
তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আসসাদিকজামান বলছেন হাওড়ে অলওয়েদার সড়ক হওয়ায় এখন ছুটির দিনে প্রচুর পর্যটক বেড়াতে আসেন কিন্তু কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি।
“ট্রলারগুলো লাইফ জ্যাকেট দিয়ে থাকে। প্রয়োজনে নৌ-পুলিশ আছে তারা সহায়তা করে,” বলছিলেন তিনি।
তবে সম্প্রতি সেই নিকলী হাওরে ঘুরে এসে ঢাকার সাদিয়া রহমান বলছিলেন, হাওরে পুরো একদিন ঘুরেছিলেন তারা গত মাসে কিন্তু নৌ পুলিশ বা টহলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাউকে তারা দেখেননি।
শুক্রবারের এই দলটির সাথে যারা গেছেন তারা বলছেন তাদের ট্রলারে ৫/৭ টির মতো লাইফ জ্যাকেট ছিলো যদিও যাত্রী ছিলো অর্ধশত।
“কার্যত কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা পর্যটকদের সতর্ক করার মতো কোন ব্যবস্থা আমরা দেখিনি,” বলছিলেন তাদের একজন।
বিজয়বাংলা/১১/৯/২০২১