সন্তান—পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত আপনার খেলনার বস্তু। দশ বছর বয়স পর্যন্ত আপনার খাদেম। পনেরো বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে পূর্বেই আপনি তাকে নিজের বন্ধু বানিয়ে নিন। অন্যথায় সে যে করেই হোক আপনার শত্রুতে পরিণত হবে।
বিশ বছর পূর্বে আমার নিজের কাছেও এই কথাগুলো খুব কঠিন মনে হতো। ভাবতাম, পনেরো বছর পূর্ণ হওয়ার পর আমার সন্তান আমার শত্রু কেনো হবে?
কিন্তু একজন জ্ঞানী আমাকে বলেন, আপনার সন্তান প্রথম পাঁচ বছর আপনার খেলার বস্তু থাকে। পুরো বাড়ির সবার প্রিয়। সবার চোখের মনি। আপনি তাকে যথাসাধ্য সময় দেওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে সেও আপনাকে যথাসাধ্য ভালোবাসা বিলাতে চেষ্টা করে। তার চোখে তখন বাবা-মা পৃথিবীর সবচে’ দয়ালু, সাহসী, মেধাবী, সম্পদশালী মানুষ হয়ে থাকে।
এরপর কয়েকটি বিষয় ধাপে ধাপে তার সামনে আসতে থাকে।
১। সে স্কুলে ভর্তি হয়।
২। তার পরের ছোটো ভাই-বোনের জন্ম হয়ে যায়।
৩। আপনার ব্যস্ততা বেড়ে যায়।
৪। আগে সে যেটুকু সময় আপনার কাছ থেকে পেতো তা ভাগাভাগী হয়ে যায়।
৫। স্কুলে তার নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয় ঘটে।
৬। কোনো কোনো শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব তাকে প্রভাবিত করে, ফলে সেই শিক্ষককে ভালো লাগতে শুরু করে।
তখন তার পছন্দের তালিকায় আপনার অর্থাৎ বাবা-মায়ের অবস্থান হয়, ৩য় কিংবা ৪র্থ নম্বরে।
দশ বছর বয়সে সে আবার তার পছন্দের টপ-টেনের লিস্টকে ঢেলে সাজায়।
১। বন্ধু-বান্ধব।
২। কোনো প্রিয় শিক্ষক।
৩। টিভি বা ফিল্মের কোনো নায়ক বা মডেল অথবা কোনো খেলোয়ার।
পনেরো বৎসর পূর্ণ হতে হতে সন্তান বাবা-মায়ের উপদেশ শুনে শুনে, মার-পিট ও ধমক খেতে খেতে পিতা-মাতার প্রতি বিরক্ত হয়ে যায়। এই বয়সে এসে অধিকাংশ টিনএজ সন্তান বাবা-মাকে শত্রু জ্ঞাণ করতে শুরু করে।
১। নিজের স্বাধীনতার শত্রু।
২। নিজের ইচ্ছার শত্রু।
৩। বন্ধুদের শত্রু।
একটি কথা ভালোভাবে নোট করে নিন-
এটি শুধু আমাদের দেশে নয়; বরং সারা পৃথিবীর সকল দেশের টিনএজ সন্তান ও তাদের বাবা-মায়ের মধ্যকার সমস্যা। যদি আমরা পশ্চিমা টিনএজ সন্তান ও তাদের পিতা-মাতার মধ্যকার সমস্যা সম্পর্কে জানি তাহলে আমাদের চোখ কপালে উঠে যাবে। সে হিসেবে যদিও আমাদের দেশের অবস্থা অনেক ভালো, তথাপি এনিয়ে আত্মপ্রবঞ্চনায় ভোগার সুযোগ নেই। যদি এই সমস্যা থেকে উত্তোরণ পেতে চাই তাহলে তাদের সাথে মহব্বতের সম্পর্ক বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদেরকে সংশোধনের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি।
আমি কয়েকটি সহজ টিপস শেয়ার করছি:
১। সন্তান যখন বড়ো হতে শুরু করে তখন তাদের সমস্যাও বড়ো হতে থাকে। একারণে তার সাথে তুই-তোকারি করা ও আমিত্ব প্রদশর্ন বন্ধ করে দিন। অর্থাৎ, নিজের জেদ পূর্ণ করতে গিয়ে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা ছেড়ে দিন।
২। টিনএজ সন্তানকে পূর্ণ ও প্রাপ্তবয়ষ্ক মনে করুন। কোনো ভাবে তাকে হালকাভাবে নিবেন না। তার সাথে যুক্তি ও দলীলের আলোকে কথা বলুন। মনোযোগ সহকারে তার বক্তব্য শুনুন। তার সমস্যা শুনে সমাধানের চেষ্টা করুন। তার সাথে রাগতঃস্বরে, তিরষ্কার করে কিংবা তাকে খাটো করে কথা বলা বন্ধ করুন, না হলে সে আপনার সাথে কথা বলা ছেড়ে দিবে।
৩। একথা মেনে নিন যে, শুধু আপনার সন্তান নয়; বরং পৃথিবীর সকল টিনএজ সন্তানই এমন হয়। আপনিও কম-বেশী এমনই ছিলেন। বিশ্বাস করুন, আমিও এমনই ছিলাম।
৪। তাকে সাহস দিন। তার ভালো কাজের প্রশংসা করুন। উদাহরণতঃ রেজাল্ট বের হওয়ার পর বলুন, তুমি যেভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছো এটি অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। আপনার এটুকু প্রশংসা তাকে প্রত্যয়ী করে তুলবে।
৫। সন্তানের প্রতিভা চিহ্নিত করে, সে ক্ষেত্রে সাহস দিন। অর্থাৎ, লক্ষ্য করুন কোন কাজটি আপনার সন্তান নিজে নিজেই অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে, গুরুত্বের সাথে করছে। তার সেই ভালো গুণটিকে চিহ্নিত করে তার প্রশংসা করুন। যেমন, সে সত্য কথা বলে। সময় মতো নামায আদায় করে। সময়ের গুরুত্ব বুঝে। বড়োদের সম্মান করে। তাহলে আয়োজনের সাথে তার প্রশংসা করুন। অর্থাৎ তার ছোটোখাটো গুণগুলোও চিহ্নিত করে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিন।
৬। সন্তানের সাফল্যকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উপভোগ করুন।
৭। একেকবার একেক সন্তানকে সাথে নিয়ে লংড্রাইভে যান। সেই সফরে আপনি শুধু প্রশ্ন করে চুপ থাকুন। নব্বই শতাংশের চেয়ে বেশী তাকে বলতে দিন। আপনি শুধুমাত্র দশ শতাংশ কথা বলুন। সে সময়ে নসীহত নয়; শুধু প্রশ্ন করুন।
৮। আপনার সন্তান যদি আপনার কথা মনোযোগ সহকারে না শুনে তাহলে, আপনার বংশের বড়ো কারো মাধ্যমে, কিংবা যেই শিক্ষকের দ্বারা সে প্রভাবিত তার সাহায্য নিন। তার মাধ্যমে প্রজ্ঞার সাথে তাকে মোটিভেট করুন।
৯। প্রত্যেক টিনএজ সন্তানই অ্যাডভেঞ্চার ও থ্রিল প্রিয় হয়। একারণে মাঝে মাঝে এমন ইভেন্টের আয়োজন করুন, যাতে তার মানবীয় এই চাহিদাটিও পূর্ণ হয়ে যায়। যেমন, সাইকেলিং, সাঁতার, কুস্তি, ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, লংজাম্প। মাঝে মাঝে আউটডোরেও যেনো সে খেলা-ধুলা করতে পারে সেইসব সামানা ও অনুমোদনের ব্যাবস্থা রাখুন।
সর্বোপরি তাকে বুঝুন, তাকে সময় দিন, ভালোবাসা দিয়ে তাকে আপন করে নিন। তাকে নৈতিকতার দীক্ষা দিন শুরু থেকেই।
Lesanul Haque